#দাদার_মোটরসাইকেল_বিলাপ (২১)
#হঠাৎ_দেখা_সত্যিকারের_বাইকার (#Sudden_meeting_with_true_bikers)
সারাদিন অফিসের মাথা খারাপ করা কাজের পর আমি মাঝে সাঝে কোনোদিন বিকেলবেলায় হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে কোনো একটা মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, এই আসে পাশেই কোথাও একটু চা খেয়ে আসতে। সেইরকমই, গতকাল বেরিয়েছিলাম একটুখানি NH2 ধরে এই গলসি পর্যন্ত্য। ধীরে ধীরে সূর্য্য ডুবছে, আমি আর #ফেথ_গুর্খা, ডুগ ডুগ করে মোটামুটি ৬০-৭০ কিমি/ঘন্টায় চলেছি। হঠাৎ একটা দারুন মজাদার জিনিস হলো ….
তিনটে ১৫০সিসি পালসার বা ওই গোত্রীয় বাইক সাই-সাই করে প্রায় ১২০ কিমি স্পিডে আমায় পার করে ধা দৌড় … তাতে তিনজন যুবক – তিনজনেই দেখে মনে হলো মাথায় এমটি বা আরাই টাইপের কোনো হেলমেট পরে, সকলের পরনেই একটা করে কালো বাইকার জ্যাকেট, চোঁ-চা করে ফাটাতে ফাটাতে দেখলাম তারা আবার আমায় আবার বুড়ো আঙ্গুল, দুটো আঙ্গুল ইত্যাদি তুলে ‘ভি’, ‘থাম্স আপ’ দেখিয়ে গেলো … বুঝলাম …”লে পচা – বাইকারদের মধ্যে ফেঁসে গেছি”। তা কি আর করবো … চুপচাপ রাস্তার ধার দিয়ে আমার গন্তব্য চায়ের দোকানে পৌঁছোলাম … গিয়ে দেখি সেই তিনজন মূর্তিমান সেখানেই দাঁড়িয়ে, চা খাচ্ছে। একজনের বাইকের পেছনে একটা স্টিকার … তাতে লেখা #একটু_আলাদা (ফটোটা দিলাম পোস্টে)
আমাকে বা আমার পেল্লাই গোফ জোড়া বা আমার #দেশি_ববার বাইকটিকে দেখেই মনে হয় তাদের একটু কৌতূহল হলো .. তারাই আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো … “স্যার … ইটা কি বাইক? দাম? হাতে বানানো? মাইলেজ? ইত্যাদি?” সেইসমস্ত্য কথাবার্তা ধরেই তাদের সাথে আলাপ পরিচয় শুরু হলো … এবং আমার মাথায় চিন্তার শুরু এখন থেকেই ….
প্রথমেই তাদের নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম ভুল করে … নাম শোনা মাত্রই চমকে উঠলাম … তাদের নাম যথাক্রমে – #রক_রাইডার_বংশী, #স্টাইলিস্ট_পাঙ্ক_বিশু আর #রফিকুল_ইয়ামাহা_মটোভ্লগ। মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো .. “বাবা মা এই নামগুলো রেখেছে ভাই ?” তাদের সপ্রতিভ জবাব .. “না স্যার, এগুলো ফেসবুকের নাম, নাহলে কেউ পাত্তাই দেয় না যে আমরা রাইডার। আবার আমার প্রশ্ন … “তা তোরা করিস কি ?” তাদের অনেক বক্তব্য থেকে উদ্ধার করতে পারলাম যে একজনের বাবা মাছ বিক্রেতা, একজন টোটো চালায় আর একজনের বাবা ফলের দোকানদার, তারা বাবাদের কাজে সাহায্য করে, আর খালি সময়ে তারা রাইডার।
আমাকে প্রশ্নই পেয়েছে .. আমার পরের প্রশ্ন ” তা ভাই, পড়াশোনা কতদূর ?”, জানতে পারলাম একজন ক্লাস সিক্স, একজন মাধ্যমিক ফেল আর একজন মাধ্যমিক পাস্। পরের প্রশ্ন … “ভাই এই আরাই এর হেলমেটের দাম তো কুড়ি হাজার টাকা, কিনলি নাকি ? ” তাদের সম্মিলিত জবাব, “আরে স্যার, আমরা সেয়ানা পাবলিক .. ইটা ওই বাঁশকোপার পাশে রাস্তার ধার থেকে ২৫০ টাকায় কেনা, পানাগড়ের স্টিকারের দোকানের মদনদা সব দেশি হেলমেটকে বিদেশী বানিয়ে দেয ৫০ টাকায়”। “আর জ্যাকেটগুলো ?” … তাদের উত্তর … “ওটা স্যার বাবা দিয়েছে, পুজোর সময়, বাবাকে বলে দিলাম একটা জ্যাকেট দাও, আর কোনো জামাকাপড় চাই না, তাই বাবা দিয়ে দিলো ” …. তাদের মনকাড়া স্বীকারোক্তি … “আসলে স্যার এই জ্যাকেট, বিদেশী হেলমেট না পরলে এই বাইকার মিটগুলোতে বড় অপমান হয়” … আমার প্রশ্ন শেষ হয় নি, লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “তা তোরা বাইকে করে যাস কোথায় ??”; শুনে প্রচণ্ড ইমপ্রেস হলাম .. এই বাচ্চা ছেলেগুলো একবার বাইকে পুরী, একবার দীঘা, একবার মুর্শিদাবাদ গেছে .. প্রচণ্ড আনন্দর সঙ্গে জানালো সামনের বছর তারা গরুডংমার যাবেই। ততক্ষনে আমার সাথে “দাদা -ভাই” সম্পর্কও হয়ে গেছে, আবার আমার প্রশ্ন – “তা তোরা এতো জোরে চালাস কেন বাইক? এই যে ১২০ তে এলি, শালা মরবি তো এক্সিডেন্ট করে, আমাকেও মারতিস শালারা “। একটু লজ্জা পেয়ে গেলো তারা, বললো “স্যার সরি, ভুল হয়ে গেছে। আসলে স্যার, সারাদিন এই বাজারের মধ্যে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করছে সবাই, কাস্টমাররা ঝগড়া করে চলেছে, মা দিনরাত বাড়িতে চিৎকার করছে, বাবা ধমকাচ্ছে যে ছেলেটা বখে গেলো বাইক নিয়ে, তখন শালা এই মাঝেসাঝে বাইক নিয়ে বেরিয়ে একটু একশো-কুড়ি তুলে মনে হয়, স্যার, ভালো আছি। মনের সব চিন্তাগুলো চলে যায় স্যার, দুঃখ থাকে না একটুও”। একটু বোঝালাম তাদের – “বাবারা, একটু সাবধানে চালাস … বাড়িতে বাবা মা আছে “, তারা বললো … “হ্যাঁ স্যার .. সেইজন্যেই তো চিন্তা, নাহলে কবেই বাইক নিয়ে রাস্তায় পালাতাম … কিছু না কিছু করে চালিয়ে নিতাম স্যার, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে যেতে ”
ভালো লাগলো এই সুন্দর, সরল, নির্ভীক বাচ্চা ছেলেগুলোর সাথে কথা বলে, তাদের চা বিস্কুটটা আমিই খাওয়ালাম … “স্যার নমস্কার, আলাপ করে দারুন লাগলো, রাস্তায় দেখা ঠিক হয়ে যাবে স্যার একদিন” বলে তারা আবার ধা করে ১২০ তুলে তিনজন হাওয়া।
প্রথমে দেখা হওয়ার সময় ভেবেছিলাম … “শালা ছোটলোকের দল … এরা হবে বাইকার ? শালারা সবথেকে বড় ঝামেলাবাজ … ফালতু চালায় জোরে, এক্সিডেন্ট করে, পুলিশের সাথে ঝামেলা করে ” … কিন্তু আমি ভুল …. বাচ্চা ছেলেগুলো হয়তো একটু ভুল বাঁকে দাঁড়িয়ে, হয়তো তারা বাইকের গ্ল্যামারটাকে একটু বেশি করে দেখে, হয়তো তারা গরিব , হয়তো তারা বেশি পড়াশোনাও করেনি …. কিন্তু তারা সরল, সৎ, নির্ভীক … তারা একটাও মিথ্যা কথা বলে নি আমায়। তারা নিজেরা জানে যে, দামি জ্যাকেট, দামি হেলমেট না হলে বাইকারকুলে ঠাঁই নেই … কিন্তু তারা নিজের অজান্তে তাদের বাবার বয়সী এক বুড়ো বাইকার কে একটা শিক্ষা দিয়ে গেলো …. “এই হেলমেট জ্যাকেট আর বাইকার মিট দিয়ে কিছুই হয় না … বাইকার হতে গেলে একটা “বাইকার -মন ” চাই’ … সেটা এই সিক্স-পাস, মাছওয়ালা, পালসার ভাইয়ের, এই দাদার থেকে বেশিই আছে … রাস্তার ডাক আছে। একটু দরকার তাদের একটা ভালো দাদার … যে তাদের জীবনের পার্সপেক্টিভটা, সকলের সাথে চলার, একটা মুখোশ পরে ফেলার রাস্তাটা, একটু সঠিক করে দেবে।
আজ এইটুকুই .. জয় হিন্দ।
No Comment! Be the first one.